নবীজিকে স্বপ্ন দেখা শেখ সাদী (রহঃ) এর জানা-অজানা।

ইরানের সাহিত্য জগতে ‘শাহনামা’র রচয়িতা কবি ফেরদৌসির পরই রয়েছে শেখ সাদীর অবস্থান।আমাদের বাংলা গদ্যের জনক যেমন বলা হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে, তেমনি ফারসি গদ্যের জনক ধরা হয় কবি শেখ সাদিকে। তিনি প্রথম দিকে কিশোরদের জন্য উপদেশমূলক গল্প-কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার ‘গুলিস্তাঁন’ গ্রন্থটি সে কারণেই ছোট ছোট উপদেশ গল্প ও চরণে সাজানো।

সন্ধ্যা রাতে কুপির আলোতে বই পড়ছে ছেলেটি। হঠাৎ তেলের অভাবে কুপিটি গেল নিভে। ছেলেটি চিন্তায় পড়ে গেল। কী করবে এখন। এমন সময় সে দেখতে পেল একজন প্রতিবেশীর রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে কিছু আলো বেরিয়ে আসছে। ছেলেটি করলো কী, সঙ্গে সঙ্গে বইটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই আলোকিত জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে একমনে বইটি পড়তে লাগলো। এমন সময় সেই ঘরের কর্ত্রী জানালা দিয়ে কিছু গরম পানি বাইরে ফেললেন। আর অমনি এক আর্ত চিৎকার। চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এলো। দেখলো ছেলেটির শরীরে গরম পানি পড়েছে আর ছেলেটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

এটা দেখে সবাই যেমন আশ্চর্য হলো, তেমনি মর্মাহতও হলো। গৃহকর্ত্রী ছেলেটির গায়ে ঔষধ লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “বাছা, তোমার পড়াশুনার জন্য কুপির যত তেলের দরকার, সব খরচ আজ থেকে আমি দেব। তুমি লেখাপড়া চালিয়ে যাও। লেখাপড়া করে অনেক বড় হও।”
হ্যাঁ, ছেলেটি অনেক বড় হয়েছিল। তাঁর রচিত নাতে রসূল-

“বালাগাল ওয়ালা বে কামালেহী
কাশাফাদ্দোজা বে জামালেহী
হাছানাত জামিয়ো খেছালেহী
ছাল্লু আলায়হে অ-আলেহী”।

মিলাদ মাহফীলে এই নাতে রসূলটি আমরা সবাই পাঠ করি।। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, শেখ সাদী এই নাতে রাসূলটির লেখা শেষ করেছিলেন একটি স্বপ্ন দেখার পর। নাতে রসূল হচ্ছে একটি কবিতা যা বিশেষ করে নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রশংসা করে লেখা।

এই নাতে রসূল লেখার পিছনে একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ ঘটনা আছে। যখন শেখ সাদী (রহঃ) এই নাতে রসূল লেখেন, তিনি তিনটি লাইন লেখার পর শেষ লাইনটি আর লিখতে পারছিলেন না যাতে এই নাতে রসূলটি সম্পূর্ণ হয়। ফলে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না এবং চিন্তিত ছিলেন এই ভেবে যে কেন তিনি শেষ লাইনটি লিখতে পারছেন না। এই চিন্তা করতে করতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। অবিশ্বাস্যভাবে ঘুমের ভিতরে দেখলেন যে তিনি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) -এর সামনে গিয়ে হাজির হয়েছেন। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী হয়েছে? আপনি এত চিন্তিত কেন? আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে সালাম দিয়ে তিনি বললেন— আমি আপনার প্রশংসাতে একটি নাতে রসূল লিখেছি কিন্তু শেষ লাইন মেলাতে পারছি না। নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উত্তর দিয়েছিলেন, তুমি যা লিখেছিলে তা এখানে পড়। তিনটি লাইন পড়া শেষের সাথে সাথেই চমকে দিয়ে নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলে উঠলেন— ছাল্লু আলায়হে অ-আলেহী। এভাবেই এই সুন্দর নাতে রসূল তার পূর্ণতা পেল।

ফার্সি সাহিত্যে একটি প্রবাদ আছে— ‘সাতজন কবির সাহিত্যকর্ম রেখে যদি বাকি সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফার্সি সাহিত্য টিকে থাকবে। এই সাতজন কবির অন্যতম শেখ সাদি।’

শেখ সাদির পুরো নাম আবু মুহাম্মদ মোশাররফ উদ্দিন বিন মোসলেহ উদ্দিন আবদুল্লাহ সাদি সিরাজি। তিনি ইরানের সুপ্রসিদ্ধ ‘সিরাজ’ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে দেশের রাজদরবারে সাদির বাবা চাকরি করতেন। সাদির বাবার নাম সৈয়দ আবদুল্লাহ। মায়ের নাম মাইমুরা খাতুন। কৈশরের আগেই কবির বাবা মারা যান। এ কারণে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল অনেক কষ্টে। তার মা তাকে নিয়ে বড় কঠিন বিপদে পড়ে যান। শেষমেশ রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পিত হয় তার নানার ওপর। কিন্তু নানার অবস্থাও সচ্ছল ছিল না। এদিকে স্বভাবকবি বলেই সাদির জ্ঞান, তৃষ্ণাও ছিল প্রবল। মা ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন ছেলেকে কীভাবে মানুষ করবেন। এতিম সাদিকে নিয়ে তার মা কতটা কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন তা কবি নিজেই বর্ণনা করেছেন। উঠতি যৌবনে  বেপরোয়া সময়টাতে একদিন মূর্খতাবশত মায়ের সামনে চিৎকার করে উঠলে মা ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ঘরের কোণে বসে থাকেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মনে হচ্ছে, তুমি তোমার শৈশব ভুলে গেছ, তাই তেজ দেখাচ্ছ। তাকে নিয়ে মায়ের ভাবনার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল সাদির অসম্ভব মেধাশক্তি।

ছোট্ট শেখ সাদি আর্থিক অনটনে স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এক ধনী ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী এবং পরিশ্রমী। ‘পরিশ্রম  সৌভাগ্যের প্রসূতি’ কথাটিতে ছিল তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস। বাগদাদ নগরীতেই তিনি বেড়ে ওঠেন। ২১ বছর বয়সে শেখ সাদি একটি কবিতা লিখে বাগদাদের প্রধান বিদ্যালয়ের নিজামিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক আবুল ফাতাহ বিন জুজিকে দেন। সেই শিক্ষক তা পড়ে মুগ্ধ হয়ে শেখ সাদির মাসোয়ারার ব্যবস্থা করে দেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই সঙ্গে ধর্ম, দর্শন আর নীতিশাস্ত্রে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করে ‘মাওলানা’ উপাধি লাভ করেন। এরপর তিনি মক্কায় হজ করতে যান। তার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য— তিনি ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। সে সময়ের পারস্য ছাড়াও তুরস্ক, সিরিয়া, জেরুজালেম, আর্মেনিয়া, আরব, মিসর, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্তান এবং ভারতের পশ্চিমাংশ ভ্রমণ করেন। তার বয়স যখন আশি বছর তখন বাগদাদ নগরী হালাকু খান দ্বারা আক্রান্ত হলে হালাকু খানের নৃশংসতায় তিনি মর্মান্তিক কষ্ট পান। ভিতরে ভিতরে এতই কষ্ট পান যে তাকে পীড়িত করতে থাকে। বাগদাদের সঙ্গে ছিল তার হৃদয়ের সম্পর্ক।

শেখ সাদি নিজের সাদি ডাকনামটি গ্রহণ করেছিলেন- সেলজুকি বংশের পঞ্চম সম্রাট বাদশা মুজাফফর উদ্দিন কুতলুগ খান আবুবকর বিন সাদ বিন জঙ্গির (১২৩১-১২৬০) নাম থেকে। এ বাদশার যুগেই ১২৫৮ সালে কবি ছয় দশক পরে তার জীবনের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে শিরাজে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি তখন ইরানি জনগণসহ সাদিকে বিপুল সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করেছেন। ইরানে ফেরার পরেই সাদি তার বিখ্যাত গ্রন্থ গুলিস্তাঁ রচনা করেছেন। যতদূর জানা যায়, সাদির বেশিরভাগ রচনা শিরাজে প্রত্যাবর্তনের পরেই রচিত যুক্তিও সে-কথাই বলে। সুতরাং ‘সাদি’ ডাকনাম গ্রহণও সে কারণেই যথার্থতা পেয়েছে। সাদি কবি জীবনে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রশংসা করেছেন। তার মধ্যে রয়েছেন সাদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ও আলাউদ্দিন আতা মুলক জুয়াইনি। দুজনেই ছিলেন সে আমলের বিজ্ঞ মন্ত্রী। তবে তার কাছে সবচেয়ে প্রশংসনীয় ব্যক্তি ছিলেন এই বাদশাহ যার নামকে তিনি নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। যদিও সে প্রশংসায় কোনো তোষামুদি কিংবা অতিরঞ্জন নেই। তার রচিত ‘গুলিস্তাঁন’ গ্রন্থটিও বাদশার নামে উৎসর্গ করেছেন। বাদশার মৃত্যু হলে গুলিস্তাঁন থেকে দুটি মর্সিয়াও তার উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়।


সাদির জীবনীকারগণ লিখেছেন— সাদির বাবাও এই বাদশার বাবা সুলতান আতাবক সাদ বিন জঙ্গির দরবারে চাকরি করতেন। কবির বাবা যখন মারা যান তখন তিনি তার শৈশব পার করতে পারেন নি। যার ফলে বাবার তেমন স্মৃতিও তার মনে নেই। যা দু-একটি মনে আছে, সেটুকু অবশ্য তিনি বর্ণনা করতে ভোলেন নি। সুতরাং ঐতিহাসিক সূত্রে তেমন কিছু পাওয়া না গেলেও তার নিজের লেখা থেকে পাওয়া যায়— তিনি যখন নিতান্ত ছোটো তখন তার বাবা লেখার জন্য তাকে একটি ‘স্লেট’ এবং হাতের আঙ্গুলে পরার জন্য একটি আংটি কিনে দেন। কিন্তু এক মিষ্টি বিক্রেতা কবিকে মিষ্টি দিয়ে ভুলিয়ে আংটি নিয়ে চম্পট দেয়। বোঝা যায়— কবি মিষ্টি বেশ পছন্দ করতেন।

একবার ঈদের দিন লোকজনের ভিড়ে শেখ সাদি পিতার জামার প্রান্ত ধরে হাঁটছিলেন, যেনো পিতা থেকে বিচ্ছিন্ন্ হয়ে না যান। কিন্তু পথে খেলাধুলায় মত্ত ছেলেদের দেখে জামার প্রান্ত ছেড়ে তিনি তাদের দেখতে লেগে যান এবং যথারীতি হারিয়ে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। পরে তার বাবা তাকে ফিরে পাওয়ার সময় রেগে গিয়ে বলেন— “গাধা, তোমাকে না বলেছিলাম কাপড় ছাড়বে না।” এ ঘটনা কবির হৃদয়ে রেখাপাত করে এবং তিনি সারা জীবনের জন্যে বুঝতে পারেন— বড়দের ‘প্রান্ত’ কখনো ছাড়তে নেই। তা হলেই পথাহারা হবার সম্ভাবনা থাকবে।

আরেকটি ঘটনা থেকে জানা যায়— একবার তিনি বাবার সঙ্গে সারারাত মসজিদে ইবাদত করে কাটিয়ে দিলেন। এ সময় মসজিদে কয়েকজন দরবেশ ঘুমে ছিলো অচেতন। সকালে সাদি তার বাবাকে বললেন— “এই দরবেশদের একজনেরও তাওফিক হলো না জেগে দু-চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ার। এতোটা গাফেল যে, মনে হয়েছে, মরা লাশ পড়ে আছে।” সাদি বলেন— এ কথা শুনে বাবা আমাকে বেশ ধমকালেন। বললেন— তুমি যদি শুয়ে থাকতে তবে সেটাই বরং এই পরচর্চা থেকে অনেক ভালো কাজ হতো।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে রয়েছে একটি বিশাল কার্পেট। জাতিসংঘের প্রবেশপথের দেয়ালে সেঁটে থাকা সেই কার্পেটটি ইরানি জনগণের পক্ষ থেকে দেওয়া উপহার। যার মাঝখানে লেখা আছে মহাকবি শেখ সাদির একটি কবিতা ‘সব মানুষ এক দেহের অঙ্গসম; যেহেতু সবার প্রথম উপাদান একই। যখন একটি অঙ্গ ব্যথায় আক্রান্ত হয়, বাকি অঙ্গও তখন স্থির থাকতে পারে না। অন্যের দুর্যোগে যদি উদ্বিগ্ন না হও, তবে তোমার নাম মানুষ হতে পারে না।’ ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মার্চ মাসে ইরানের নববর্ষ (নওরোজ) উপলক্ষে সে দেশের জনগণকে ভিডিওর বার্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছা পাঠান। সেখানে বারাক ওবামা কোট করেন শেখ সাদির একই কাব্যাংশ। তিনি বলেন, এটি ঠিক যে, আমরা নিজেদের মধ্যে কতগুলো বিভাজনের কারণে বিভক্ত হয়ে আছি। তবে আমরা সেই শব্দগুলো মনে রাখতে পারি, যা কবি সাদি লিখে রেখেছেন বহু বছর আগে। আদম সন্তান সবাই এক দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মতো, যেহেতু সবাই একই উপাদান থেকে তৈরি।


 ভারতের কংগ্রেসনেত্রী সোনিয়া গান্ধিও শেখ সাদির ‘জন্ম বার্ষিকী’ উপলক্ষে এক বাণীতে বলেছিলেন— সাদির কবিতা সময় ও ভৌগলিক সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে গোটা মানবতা এবং জাতিগুলোর সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। ভারতীয়রা সব সময়ই সাদির মহতী কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে এবং তার কবিতা আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক সমস্যাসহ বড় ধরনের বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও প্রজ্ঞাপূর্ণ দিক-নির্দেশনা ও প্রশান্তির উৎস।

 উনার সর্ম্পকে যেহেতু এই লিখাটি সেহেতু মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে কিছু বলতেই হয়। ভাস্কর্য ও মূর্তি যে এক না সেটি আমাদের দেশের বেশিরভাগই বুঝতেই চান না। আর  এই শেখ সাদীর মাজারের সামনেই তার একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য আছে।কিন্তু সেখানের ধর্মপ্রান কেউই আমাদের মত বিরোধিতা করে না কারন তারা মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্য ভালভাবেই জানেন।

নিজের দীর্ঘ জীবনকে শেখ সাদি চার ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। ৩০ বছর লেখাপড়ায়, ৩০ বছর দেশ ভ্রমণে, ৩০ বছর গ্রন্থ রচনায়, ৩০ বছর আধ্যাত্মিক চিন্তায়
নিজের ওপর বিশ্বাসের দৃঢ়তা থাকলেই এটি কারও পক্ষে এমনটি করা সম্ভব। আর তাইতো বাগদাদ থেকে লেখাপড়া শেষ করেই শেখ সাদি দেশ ভ্রমণে বের হন। তিনি এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় দীর্ঘ সময় ব্যয় করে ভ্রমণ করেন। শোনা যায় তাঁর জীবনের উক্ত চারটি পর্যায় যেদিন পূর্ণ হয় সেদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শেখ সাদি দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে এমন পাণ্ডিত্য অর্জন করেন যে তিনি আঠারটি ভাষা রপ্ত করতে সক্ষম হন। এর ভিতর অনেক ভাষা তার মাতৃভাষার মতোই ছিল। আর তিনি এত বেশি দেশ ভ্রমণ করেন যে ইবনে বতুতা ছাড়া প্রাচ্য দেশীয় পর্যটকদের মধ্যে কেউই এত বেশি দেশ ভ্রমণ করেননি। আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি পায়ে হেঁটে চৌদ্দবার হজ পালন করেছিলেন। তিনি তার সফরকালে অসংখ্য নদী এমনকি পারস্য উপসাগর, ভারত মহাসাগর, ওমান সাগর, আরব সাগর প্রভৃতি পাড়ি জমিয়েছেন। আর সঞ্চয় করেছেন অপরিসীম জ্ঞান। দেশ ভ্রমণকালে শেখ সাদি একবার ফিলিস্তিনের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। সেখানকার আদিবাসীদের হাতে বন্দী হয়ে অন্যান্য বন্দীর সঙ্গে কবিকে খন্দক খননের কাজও করতে হয়। সেখান থেকে মুক্তি পেতে কবিকে দশ দিরহাম মুক্তিপণ দিতে হয়েছিল।

শেখ সাদি দৈহিকভাবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ছিলেন। পায়ে হেঁটেও বহু অঞ্চল তিনি ভ্রমণ করেছেন। অনেক সময় ফকির-দরবেশের মতো খালি পায়েই তাকে চলতে হয়েছে। গুলিস্তাঁয় তিনি লিখেছেন, আমি কখনো কালের কঠরতা ও আকাশের নির্মমতার ব্যাপারে অভিযোগ করিনি। তবে একবার নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কারণ পায়ে তখন জুতা তো ছিলই না এমনকি জুতা কেনার মতো অর্থও ছিল না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ইরাকের মসজিদ আল কুফায় গিয়ে উঠলাম। তখন দেখি একটি লোক শুয়ে আছে যার একটি পা-ই নেই। তখন খোদাকে শোকর জানিয়ে নিজের খালি পা থাকাও সন্তুষ্ট হলাম। হাঁটতে হাঁটতেই তিনি দেখেছেন মুসলিম সাম্রাজ্যের শৌর্য-বীর্য, সঙ্গে সঙ্গে পতনের দৃশ্য। পায়ে হেঁটে তিনি চৌদ্দবার হজ পালন করেছেন। ভ্রমণের মধ্যে ছিল পারস্য সাগর, ভারত মহাসাগর, ওমান সাগর, আরব মহাসাগর পাড়ি। কথিত আছে, ভারত সাগর ভ্রমণ বাদে সাদি আরও তিনবার ভারতবর্ষে পদার্পণ করেছিলেন। পাঠানরাজ আলতামাশের সময় তিনি কিছুকাল দিল্লিতে অবস্থান করেছিলেন। চতুর্থবার তিনি বিখ্যাত কবি ও গায়ক আমির খসরুকে দেখতেই ভারতে আসেন। সাদি পুবে ভারতের সিন্ধু প্রদেশ অবধি এসেছিলেন। এরপরে খ্রিষ্টীয় ১৩ শতাব্দির শেষভাগে মুলতানের শাসক যুবরাজ মুহাম্মদ খান শহিদ তার পিতা গিয়াসুদ্দিন বলবনের পক্ষ থেকে শেখ সাদিকে ভারতে আসতে দুবার আমন্ত্রণ জানান।

 "বোস্তাঁন"গ্রন্থে তার ভারত ভ্রমণের ঘটনা বর্ণিত আছে। তিনি ভারতের সোমনাথ গমন করেছিলেন; সেখানকার প্রসিদ্ধ মন্দিরের দেবমূর্তিটিকে প্রতিদিন রাতে ভক্তদের প্রার্থনার জবাবে হাত উঠাতে দেখে তিনি আশ্চর্যান্বিত হন। এর রহস্য উদঘাটনের জন্য তিনি পূজারীর ছদ্মবেশে কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। তিনি বলেন—  “আমি পূজারীদের বললাম
, এখানে নতুন এসেছি, এ মহান দেবতার পূজাদি কিভাবে দিতে হবে আমাকে শিখিয়ে দিন। পূজারিগণ খুশি হয়ে আমাকে মন্দিরে নিয়ে গেলো। বললো— আজ রাতে তুমি মন্দিরে থাকো, তাহলে দেবতার শক্তি দেখতে পাবে।

আমি সারারাত মন্দিরে কাটালাম। মন্দিরের দরোজা বন্ধ করে মূর্তির নিকট গিয়ে দেখলাম— মূর্তির পিছনে একখানি পর্দার আড়ালে রশি ধরে একজন পূজারী বসে আছে। রশির একদিক মূর্তির সাথে বাঁধা। সে পূজারী যখন রশি ধরে টানে তখনই মূর্তির হাত উপরে উঠে যায় আর সাধারণ লোক তাকেই মূর্তির শক্তি বলে নাচতে থাকে। পূজারী হঠাৎ করেই পর্দার আড়াল আমাকে দেখে ফেললো। আমি তখন প্রাণের ভয়ে তাকে ধরে কূপে ফেলে দিলাম। এরপর সে রাতেই সোমনাথ ছাড়লাম। সমুদ্র পথে অতি কষ্টে হেজাজে এসে পৌছলাম।


শেখ সাদির জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতা ভরপুর। আর এসব অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে তার লেখনীর মাধ্যমে। একবার দেশ ভ্রমণের সময় তিনি দামেস্কবাসীর প্রতি বিরাগভাজন হয়ে ফিলিস্তিনের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। কিন্তু এই সময় দুর্ভাগ্যক্রমে খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের হাতে তিনি বন্দী হন। খ্রিস্টানরা বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি থেকে আনা ইহুদি বন্দীদের সঙ্গে কবিকে রাখে। শুধু তাই নয় কবিকে দিয়ে তারা খন্দক খননের কাজও করায়। কবিকে এই কাজ করতে হয়েছে দীর্ঘ সাত বছর। এক দিন সৌভাগ্যক্রমে বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাবার বন্ধু তাকে দশ দিরহাম মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে আনেন। এত কষ্ট সহ্য করার পরও শেখ সাদি নিজের লেখায় বারবার বলেছেন ‘মানবজাতি অভিন্ন মূল থেকে উদ্ভূত’।

সাদীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘বুস্তান’-এ মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, এমনকি জগতের প্রতিটি বস্তুকে বাকশক্তিস¤পন্ন দেখানো হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রতিটি বস্তুই যেন একে অপরের সহমর্মী ও বাকসঙ্গী। তাদের প্রত্যেকের মধ্যে যেন রয়েছে আত্মিক ও সুদৃঢ় বন্ধন।সাদীর মতে, এ বিশ্বজগতে একমাত্র মানুষই সম্মান, মর্যাদা, দয়া ও ভালোবাসা পাওয়া যোগ্য নয়, বরং প্রতিটি জীবেরই তা প্রাপ্য।

‘বুস্তান’-এর দশটি পর্বে শেখ সাদী যে পৃথিবী চিত্রিত করেছেন তাতে রয়েছে মহান স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভালোবাসা এবং সত্য ও সুন্দরের জয়গান, যা বিদগ্ধ পাঠক মাত্রকেই সুন্দর ও পবিত্র এক পৃথিবী বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ করবে।(ভাল লাগলে পেইজে লাইক ও শেয়ার দিবেন)

Post a Comment

1 Comments

Emoji
(y)
:)
:(
hihi
:-)
:D
=D
:-d
;(
;-(
@-)
:P
:o
:>)
(o)
:p
(p)
:-s
(m)
8-)
:-t
:-b
b-(
:-#
=p~
x-)
(k)

Ad Inside Post

Comments system