মহাকবি ফেরদৌসীর জানা-অজানা।

ইতালির রোমে ফেরদৌসীর ভাস্কর্য। 

সমগ্র পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এ পর্যন্ত  খ্যাতিমান যে কয়েকজন কবির আগমন ঘটেছে পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসী তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর শাহনামা গ্রন্থটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম মহাকাব্য।ফেরদৌসী পার্সিয়ান সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং সমগ্র পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।ফারসি সাহিত্যকে যে কয়েকজন কবি উচ্চ আসনে নিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থানে রয়েছেন।বিখ্যাত ফারসি মহাকাব্য শাহনামার রচয়িতা মহাকবি ফেরদৌসী। তাঁর পুরো নাম হাকিম আবুল কাসেম ফেরদৌসী তুসি (৯৪০-১২০০)। উত্তর-পূর্ব ইরানের তুস শহরের কাছে পাজ গ্রামে ফেরদৌসীর জন্ম। তাঁর শৈশব  ও শেষ জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি।প্রথম দিকে ফেরদৌসী সামানাইড সাম্রাজ্যের রানীর জন্য লিখেছিলেন। এ সাম্রাজ্যের পতনের পর তিনি গজনভি সাম্রাজ্যের (বর্তমান আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান ও পাকিস্তানের বড় অংশ) সুলতান মাহমুদ গজনভিকে তাঁর লেখা উৎসর্গ করেন।তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্য শাহনামার সাথে তুলনা করার মত কোন রচনা নেই বললেই চলে।গ্রিক মহাকবি হোমারের ইলিয়াডের চেয়ে শাহনামা সাত গুণ বড় ও জার্মান মহাকাব্য নিবেলুঙগেনলিয়েড-(Nibelungenlied) এর চেয়ে ১২ গুণ বড়। ইংরেজি,বাংলাসহ প্রায় সকল ভাষায় অনুবাদ হয়েছে শাহনামা। তবে বেশির ভাগ অনুবাদই সংক্ষিপ্ত।শাহনামার আগেও তিনি বেশ কিছু কাব্য রচনা করেছিলেন, তবে সেগুলো সংরক্ষণ করা যায়নি।৯৭৭-এর দিকে শাহনামা লেখার কাজ শুরু করেন ফেরদৌসী। এতে তিনি ইরানের বিভিন্ন শাসক ও শাহদের কাহিনি তুলে ধরেন।শাহনামা লেখার সময় সুলতান মাহমুদ ফেরদৌসীকে বলেন মহাকাব্যে যতগুলো শব্দ থাকবে, প্রত্যেক শব্দের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হবে।৩৩ বছর ধরে করেন মহাকাব্যের কাজ এবং শেষ হয় ৬০ হাজার শ্লোকে। শাহনামায় আছে ৯৯০টি অধ্যায়, ৬২টি কাহিনি। প্রাচীন ইরানের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি উঠে এসেছে এ মহাকাব্যে।

বর্তমান যুগে ঘরে ঘরে যেমন কবির জন্ম হচ্ছে, একটি শব্দের সাথে আরেকটি শব্দের মিল দিতে পারলেই কবি হিসেবে পরিচিত হওয়া যায়, পরিচিত হতে না পারলেও জোর করে পরিচিত হবার চেষ্টা চালায়; কিংবা ২-১টি অশ্লীল শব্দ বা বাক্য সংযােজন করে আলােচিত হবার চেষ্টা করে; তখনকার দিনে এমনটি ছিল না।যেমন তেমন লোেক কবিতা লিখতেন না। কবির মন, কবির প্রতিভাবান  শক্তি, কবির চিন্তা, কবির দেখার বিষয়বস্তু সাধারণ লােক হতে অনেক ভিন্ন ছিল।সাধারণ মানুষ যা দেখে, যা ভাবে সেগুলাে কবির চোখে নতুন করে দেখা দেয় এবং বাস্তব জীবনের সত্যগুলাে কবির হৃদয়ে জেগে ওঠে। বর্তমান অধিকাংশ কবিদের লেখা কবিতা একবার পড়লেই যেমন দ্বিতীয় বার পড়তে ইচ্ছে হয় না অপরদিকে প্রায় হাজার বছর আগে মহাকবি ফেরদৌসী ইন্তেকাল করলেও আজও প্রায় প্রতিটি মানুষের  কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তাঁর লেখা কবিতা। যতবার পড়া হয় ততবারই যেন ইচ্ছে হয় শুনতে বা পড়তে।

ইরানের রাজধানী তেহরানে ফেরদৌসীর ভাস্কর্য।   


মহাকবি ফেরদৌসীর জীবন সম্পর্কে নির্ভরযােগ্য বিশেষ কিছু লিপিবদ্ধ নেই।তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী পরে ইরানের বিখ্যাত কবি নিজামি ফেরদৌসী সম্পর্কে যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা থেকে বিস্তারিত জানাা যায়। গজনির সুলতান মাহমুদ তাকে ফেরদৌসী উপাধি দিয়েছিলেন। সে থেকেই তিনি ফেরদৌসী নামে খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর পিতা মােহাম্মদ ইসহাক ইবনে শরফ শাহ তুস নগরের রাজকীয় উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ফেরদৌসী ভাল লেখাপড়া শিখেছিলেন। তাঁর আর্থিক অবস্থাও ছিল মােটামুটি স্বচ্ছল।জানা যায়, তিনি উত্তারিধকার সূত্রে অনেক জায়গা জমি পেরেছিলেন এবং এ সব জমি থেকে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ আয় হত। তিনি বাল্য বয়স থেকেই কবিতা লিখতে ভালবাসতেন। কম বয়সেই বিয়ে করেন।যৌবনে তিনি একান্তভাবে কবিতা চর্চায় আত্মনিয়ােগ করেন এবং রাজকীয় উদ্যানের পার্শ্ববর্তী ছােট্ট নদীর তীরে বসে কাব্য লিখতেন। সুখ ও শান্তিময় জীবনের দিনগুলাে এখানেই তিনি কাটাতেন। কিন্তু সুখ তাঁর জীবনে বেশীদিন স্থায়ী হল না। তার পরিবারে তুসের শাসনকর্তার খারাপ দৃষ্টি পতিত হল। অবশেষে নিজ গৃহে অবস্থান করাই ছিল তার জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার।তার মাত্র একটি কন্যা সন্তান ছিল। কন্যাকে সৎপাত্রে বিবাহ দেয়া ছিল তার জীবনের বড় আশা।এছাড়া নিজ দেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব-অনটন দেখে তাঁর মন প্রায়ই কেঁদে উঠত।তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যেভাবেই হােক তিনি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন। কিন্তু তার মনের এ ইচ্ছা পূরণ হল না। নিজ গৃহে অবস্থান করাই যখন তার অসম্ভব হয়ে উঠল, তখন জনগণের কল্যাণে কাজ করবেন কিভাবে। তিনি কন্যাকে সাথে নিয়ে নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে পড়লেন অজানা এক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তাঁর জীবনের এ দুঃসময়ে সাক্ষাৎ পেলেন গজনীয় সুলতান মাহমুদের।

৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনীর সিংহাসনে আরােহণ করেন।তিনি দেশ বিদেশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের খুব সম্মান করতেন এবং তাছাড়া দরবারে দেশ বিদেশের কবিদের কবিতা আবৃত্তির আসর হত। মহাকবি মুহাম্মদ আবুল কাশেম ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের নিকট যথাযথ কদর পাবেন চিন্তা করে গজনীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। গজনীর রাজ দরবারে প্রবেশ করা ছিল তখন কঠিন ব্যাপার। তিনি দরবারের অন্যান্য কবিদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন। অবশেষে সুলতান মাহমুদের উজির মােহেক বাহাদুরের সহযােগিতায় তিনি রাজদরবারে প্রবেশ করেন। সুলতানের সাথে প্রথম পরিচয় হয় কয়েকটি কবিতা পাঠের মাধ্যমে। প্রথম সাক্ষাতেই সুলতান কবির আবৃত্তি ও কয়েকটি কবিতা শুনে অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং এ বলে কবিকে সংবর্ধনা করলেন,

হে ফেরদৌসী, তুমি সত্যিই আমার দরবারকে বেহেশতে পরিণত করে দিয়েছ।

এ থেকেই কবির নাম ফেরদৌসী হল এবং পরবর্তীতে তিনি ফেরদৌসী হিসেবেই খ্যাতি লাভ করেন। সুলতান কবির জন্য পৃথকভাবে উন্নতমানের বাসস্থান ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং কবিকে রাজকবি হিসেবে মনােনীত করেন। আস্তে আস্তে কবি ফেরদৌসীর সাথে সুলতান মাহমুদের সম্পর্ক গভীর হয়ে যায়। কবির কবিতা ও তাঁর জ্ঞান বুদ্ধিতে সুলতান তার প্রতি মুগ্ধ হন। কিন্তু এখানেও সুলতানের সাথে কবির গভীর সম্পর্ক আজীবন স্থায়ী হল না।কবি ফেরদৌসীর সাথে সুলতানের গভীর সম্পর্ক এবং রাজদরবারে কবির শ্রেষ্ঠ সম্মান দেখে রাজসভার অন্যান্য কবিরা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল এবং কবিকে রাজদরবার থেকে বের করার জন্যে কবির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করল। অন্যদিকে সুলতানের প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দীও কবির সাথে গােপনে শক্রতা আরম্ভ করলাে। ইতিমধ্যে সুলতান মাহমুদ কবিকে ' মহাকাব্য শাহনামা' রচনা করার অনুরােধ জানান এবং এর প্রতিটি শ্লোকের জন্যে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। যতদূর জানা যায়, কবি সুদীর্ঘ ৩০ বছর পরিশ্রম করে শাহনামা রচনা করেন। এর মধ্যে শেষের ২০ বছর কবি রাজসভাতে কাটান।' শাহনামা ' পৃথিবীর মহাকাব্য সমূহের মধ্যে অন্যতম। ইহা ৭ টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত এবং ৬০ হাজার শ্লোক রয়েছে এতে।কাব্যের কোথাও অশ্লীল বাক্য বা ইতর উপমার প্রয়ােগ নেই। কবি নিযামীর মতে শাহনামা' কাব্য রচনা শেষ হয় হিজরী ৩৯৩ সনে। শাহনামা ' কাব্য রচনা শেষে সুলতান রাজদরবারের কতিপয় ঈর্ষাপরায়ণ ও ষড়যন্ত্রকারীদের কুমন্ত্রণা শুনে তার প্রতিশ্রুতি ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রৌপ্যমুদ্রা মতান্তরে ৬০ হাজার দিরহাম প্রদান করেন। সুলতান কবির বিরুদ্ধে আমলাদের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পারেননি। এদিকে কবি ফেরদৌসী সুলতানের প্রতিশ্রুতি ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে ক্রোধে, ক্ষোভে ও দুঃখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কবি অর্থের লােভী ছিলেন না। বরং সুদীর্ঘ ৩০ বছর পরিশ্রমের বিনিময়ে তাকে যে অর্থ দেয়া হয়েছে তা কবি নিজের জন্যে অপমান মনে করেছেন।এছাড়া এ অর্থ দিয়ে নিজ দেশের অসহায়, গরীব, নিপীড়িত ও নির্যাতিত জনগণের এবং কন্যা সন্তানের যে উপকার করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন তা যেন সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। সুলতান হয়ে তিনি কিভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারলেন? এসব কথা চিন্তা করেই কবি সুলতানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং কবিকে সুলতানের দেয়া সমুদয় অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। শুধু তাই নয়, সুলতানের দেয়া সমুদয় অর্থ ভৃত্য, স্নানাগারের রক্ষক ও নিকটস্থ গরীব লােকদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেন। রাজ পুরস্কারকে অপমান করার ঘটনা সুলতানের কানে পৌছল। রাজসভার অন্যান্য কবি ও আমলারা সুলতানকে বিষয়টি ভালভাবে বুঝায়নি বরং তারা সুলতানের নিকট কবির বিরদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন। তারা সুলতানের নিকট কবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যা ও বানােয়াট কথাবার্তা বলে কবির বিরুদ্ধে সুলতানকে ক্ষেপিয়ে তােলেন। সুলতান ক্ষুব্ধ হয়ে কবিকে হাতির পদতলে পিষ্ট করে হত্যা করার আদেশ দেন এবং পরক্ষণে এ আদেশ তুলে নিয়ে কবিকে গজনী ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।সুদীর্ঘ ২০ টি বছর কবি কাটিয়েছেন গজনীতে। তাঁর জীবনের মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় হয়েছে এখানে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হয়ে অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে জীবন সায়াহ্নে গজনী ত্যাগ করে আবার বের হতে হন অজানা অচেনা নিরাপদ এক আশ্রয়ের সন্ধানে। গজনী ত্যাগ করার পূর্বে কবি সুলতান মাহমুদের এ হীনমন্যতার জন্যে তাঁকে গালমন্দ করে একটি ব্যঙ্গ রসাত্মক কবিতা লিখেন এবং তা মসজিদের দেয়ালে টাঙিয়ে রাতের অন্ধকারে গজনী ত্যাগ করেন।

সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুয়েস্তানের রাজা নসরুদ্দিন মুহতাসেম কবি ফেরদৌসীর উচ্চ প্রশংসা করে সুলতান মাহমুদের নিকট একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পেয়ে সুলতান খুব মর্মাহত হন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, সুলতান কবির প্রতি ন্যায় বিচার করেননি বরং ষড়যন্ত্রকারীদের কুপরামর্শে তিনি কবির প্রতি অন্যায় আচরণ করেছেন। তাই সুলতান নিজেকেই অপরাধী মনে করে কবি ফেরদৌসিকে ক্ষমা করে দেন এবং কবির প্রতি সুলতানের সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন সরূপ কবির প্রাপ্য সমুদয় স্বর্ণমুদ্রা সহ কবির জন্মভূমি ইরানের তুস নগরীতে কবির নিজ বাড়িতে দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু দূত যখন স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যান তখন কবি পৃথিবীতে বেঁচে নেই।কবির লাশ নিয়ে যখন লোকেরা দাফনের জন্য বের হন তখন দূত সেখানে স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে পৌছাঁন।তার কন্যা এ মুদ্রা গ্রহণ করেন নি। পরবর্তীতে কিছু মুদ্রা দিয়ে কবির কবর সংস্কার করা হয় এবং কিছু গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হয়।

১০২০ খ্রিষ্টাব্দে মতান্তরে ১০১৪ খ্রিষ্টাব্দে কবি এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। কবির ইন্তেকালের হাজার বছর অতিবাহিত হলেও  কাব্য ও সাহিত্যে যা রেখে গেছেন তাতে তিনি পৃথিবীতে অমর হয়ে রয়েছেন।

Post a Comment

0 Comments

Ad Inside Post

Comments system